ভূতের গল্প (৩)
নিধুভূষণ দাসআমার যত বায়না ছিল এই বন্ধুর কাছেই। পড়তাম ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ঠিক করেছিলাম পাশ করার পর বিয়ে করবো।সব পাকা।আর এক বছর বাকি ,তারপরই আমরা বিএফ -জিএফ হয়ে যাবো স্বামী -স্ত্রী। দারুন উত্সাহ আর উত্তেজনা দুজনেরই। এক ছুটির দিনে ঠিক হলো বাইকে করে সাভার যাবো জাতীয় স্মৃতি সৌধে ,ওখানে একে অপরকে বাগদানের আংটি পরাবো। তা ছিল ২৫শে ডিসেম্বর ,বড়দিনের ছুটি ,১৯৮৮ সাল। সকালেই রওনা দিলাম। শীতের সকালের হিম হাওয়াকে মনের উত্তেজনার উষ্ণতা দিয়ে পরাজিত করে উত্তুরে হাওয়ার উজানে চললো আমাদের দুচাকার গাড়ি। সকাল ১০টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম ওই পবিত্র স্থানে। আংটি পরালাম পরস্পরকে ,চুমু খেলাম, মিষ্টিও। তারপর ঢাকা ফেরার পালা।সূর্য তখন মাথার ওপরে আসেনি ,উত্তুরে হাওয়ার বিরাম নেই। আমাদের গাড়ি চলছে ৬০কিমি বেগে। টঙ্গীর কাছে হঠাত বিপরীত দিক থেকে আগুয়ান একটি বড় লরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সোজা আমাদের বাইকে আঘাত করলো। তারপর কী হলো জানিনা। এখন আমরা দুজনই তোমাদের জগতের বাইরে। তুমি হয়তো অনেক রকম ভূতের কথা শুনেছো -পেতনি ,পেঁচাপেঁচি,নিশি ডাক ,স্কন্ধকাটা। আমাদের যদি ভূত বলোই তবে আমরা কিন্তু সেরকম ভূত নই। আসলে বন্ধু ভূত ,তোমার মতো ভালো মানুষদের সাহায্য করি বরাবর। ভগবানই আমাদের পাঠান সাহায্য করতে।
জানো, আমরা দুজন স্বামী-স্ত্রী হয়েই আছি এখন এই জগতে। যখন যেখানে খুশি চলে যেতে পারি। আমার স্বামী এখন অন্য একটা কাজে গেছে ,ফিরবে মধ্যরাতে। তখন আমরা খেয়েদেয়ে ঘুমুবো। ভাবছো ,ভূতেরা আবার ঘুমুয় নাকি !এ আবার কেমন কথা ? হাঁ গো,আমরাও তোমাদের মতোই।আমরাও খাইদাই,ঘুমাই,আনন্দ-উল্লাস করি ,শুধু তোমাদের মতো বাব-মা হতে পারিনা ,তাতে বারন আছে,নয়তো আমাদের দেশে জনবিস্ফোরণ ঘটবে ,যেমন তোমাদের দেশে হয়েছে। এমনিতেই অপঘাতে মৃত্যুর পর কত মানুষ তোমাদের জগত থেকে আমাদের দেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছে।আমরা ভালো মানুষ যারা তাদের কখনো বলিনা,ঠাই নেই ঠাই নেই ,ছোটো সে তরী। তাদের আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু যারা দুষ্টু ,তাদের ছেড়ে কথা বলিনা। যেমন ,পণের বলি মেয়েদের আমরা স্বাগত জানাই ,আর যারা তাদের অপঘাতে মৃত্যুর কারণ তাদের প্রতি থাকে আমাদের তীব্র ঘৃণা ,প্রতিশোধ নিই তাদের ওপর। নারীভ্রুণ হত্যাকারী আর বধূ নির্যাতনকারীদের তোমাদের আইনি ব্যবস্থায় যে বিচার হয় তা মোটেও যথেষ্ট নয়, আমরা নিজেরাই ওদের বিচার করি ,বাড়িতে রোগ ঢুকিয়ে দিই,দুর্ঘটনার কবলে ফেলি ,জীবন দুর্বিষহ করে তুলি।
তুমি জানো কীনা ,কিছুদিন আগে তোমাদের শিলিগুড়িতে দেশবন্ধুপাড়ায় পিঙ্কি নামে একটা ফুটফুটে মেয়ে মারা গেলোনা ,সে আসলে আত্মহত্যা করেনি ,তাকে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। আর বলিহারি তোমাদের পত্রিকাগুলির ,লিখে দিলো মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। লজ্জা হওয়া উচিত তোমাদের । হত্যাকে বেমালুম আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দাও জেনেবুঝে। তোমাদের পৃথিবীতে মনুষ্যত্ব একেবারে লোপ পেতে বসেছে। জানো, পিঙ্কির স্বামীর এখন কী অবস্থা,যে হাতে মেরেছে ওকে, সেই হাত দুটি অবশ ,ওকে অনেক যন্ত্রনা সহ্য করে মরতে হবে ,সহজে মরবেনা ,সব যাবে। দোরে দোরে গিয়ে ভিক্ষা করতে হবে ,দেখে নিও। আমরা ওকে ছাড়বোনা। যে পুলিশ ও সাংবাদিকরা উল্টাপাল্টা করেছে তাদেরও ছাড় নেই। পিঙ্কি এখন আমাদের সঙ্গেই আছে। আমরা ওকে খুব ভালোবাসি। বেচারী এখনও কত কাঁদে জানো,তোমাদের পৃথিবীর নিষ্ঠুরতার কথা মনে করে ?তোমাদের পৃথিবী আমাদেরও,একে আমরা নিষ্ঠুর হতে দিতে পারিনা ,হতে দেবোনা ,বুঝলে ? (চলবে )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন